শেষ নিয়তির গল্প
শুয়ে শুয়ে মুভি দেখছিলাম ল্যাপটপে। বাইরে বেশ ঝড়, মনটাও ভালো ছিলোনা। তাই ভাবলাম একটা পুরোনো কমেডি মুভি দেখি। 'আন্দাজ আপনা আপনা' মুভিটা প্লে করে কাধের নীচে বালিশ দিয়েছি। পাশেই লাইটার সিগারেট রাখা। সিগারেট ধরাতে যাবো, এমন সময়ই কলিং বেল বেজে উঠলো। আমি বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলতে গেলাম। অসময়ে কেউ এসে বিরক্ত করলে আমার প্রচন্ড রাগ হয়। যদিও আমি সেই রাগটা প্রকাশ করি কম।
আমি রুবেল। বয়স আটাশ। একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে জব করছি। অফিস ধানমণ্ডিতে। কলাবাগানে একটা ছোট্ট ফ্ল্যাট নিয়ে একাই থাকছি। মা-বাবা থাকে গ্রামে। রাজৈরে, মাদারীপুর জেলায়। বাড়ি থেকে বিয়ের চাপ দিচ্ছে, আপাতত দুই বছর সময় নিয়েছি।
আমি প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলে দিলাম। অবাক হওয়ার মতো কেউ আসেনি। এসেছে ফাহিম। আমার কলেজ লাইফের বন্ধু। থাকে মিরপুরে। প্রায়ই আসে আমার এখানে। আমি ফাহিমের দিকে একটা টাওয়েল এগিয়ে দিলাম। "গাধার মতো ভিজে কই থেকে আসলি?" ফাহিম একগাল হেসে জবাব দিলো, "আর বলিস না। অফিসের কাজে জিগাতলা যেতে হয়েছিলো।
প্রচন্ড চাপ যাচ্ছে রে কাজের!" আমি চুপ করে মুভিতে মনোযোগ দিলাম। ফাহিম দু'কাপ চা বানিয়ে নিয়ে এলো। কড়া লিকারের গরম ধোয়া উঠা চা। আমি চায়ের কাপে চুমুক দিলাম। ফাহিম উশখুশ করতে লাগলো। বললো, "কার মুভি দেখস? আমির খানের?" আমি জবাব দিলাম না। চা খেতে লাগলাম। ফাহিম কাপ রেখে খাটের উপর উঠে বসলো। নখ দিয়ে বিছানার চাদর খুটতে খুটতে বললো, "রুবেল, তোর সাথে একটা কথা ছিলো দোস্ত!"
আমি চরম বিরক্ত হয়ে মুভি পজ করে ফাহিমের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকালাম। লজ্জায় কুঁকড়ে যাওয়া একটা মুখ। চোখ দু'টো জলে ভরা। আমি একটু নরম হয়ে বললাম, "টাকা চাইতে এসেছিস, তাইতো? দ্যাখ ফাহিম, এ পর্যন্ত ছাব্বিশ হাজার টাকা তোকে ধার দিয়েছি। আর দিতে পারবোনা। মাফ কর ভাই, এতে সম্পর্ক থাকুক বা না থাকুক।" ফাহিম জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইলো। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। প্রচন্ড বৃষ্টি। ফাহিম বৃষ্টি দেখছে। আমি বললাম, "কি করস এতো টাকা দিয়ে?
আগের টাকা কবে দিবি বল। আগামী মাসে সিকিম যাচ্ছি। টাকাটা আমার লাগবে।" ফাহিম বললো, "আমার খুব বিপদ দোস্ত, পাঁচ হাজার টাকা দে আজ, আমি পরে সব দিয়ে দেবো আস্তে আস্তে।" আমি কিছুই বললাম না। শুয়ে শুয়ে পুরো মুভিটা দেখলাম। ফাহিম বসেই রইলো। সে আমার বন্ধু, তাই তাকে অনেক হেল্প করেছি আমি। কিন্তু আমার ও তো সীমাবদ্ধতা আছে। আমি কিভাবে বারবার ধার দেই।
আমি উঠে ফ্রেশ হলাম। সকালের প্লেট গ্লাস, বাটি ছিলো বেসিনে, ধুয়ে রাখলাম। ফাহিম বসেই রইলো। এরমধ্যেই কয়েকজনকে কল দিয়ে টাকার জন্য কাকুতিমিনতি করেছে। কারো থেকেই মনে হচ্ছে সাড়া পায়নি।
ফাহিম কখনোই এমন ছিলোনা। শিবতলা আইডিয়াল স্কুলে আমরা একসাথেই পড়তাম। খুব ভালো ছাত্র ছিলো ফাহিম। কবিতা লিখতো ক্লাসে, বিজ্ঞানে তুখোড় ছিলো। আমাদের অঙ্ক স্যার ওর নাম দিয়েছিলো আইন্সটাইন। খুব মনে পরে, নাইনে থাকতে প্রথম সেমিস্টার পরীক্ষায় আমরা সবাই অঙ্কে ফেইল করেছিলাম, আর ফাহিম পেয়েছিলো একশো! সেই ফাহিম আজ ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেই একটা অফিসে ছোট্ট চাকরী করছে। বেতন খুব কম, ক'দিন পর পরই চলে আসে ধার চাইতে।
আমি ফ্রেশ হয়ে এসে দেখি দরজা খোলা। বাইরে এখনো তুমুল বৃষ্টি। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজেই ফাহিম চলে গেছে। আমি তাড়াতাড়ি ড্রয়ার খুলে দেখলাম। ত্রিশ হাজার টাকা, দুইটা ক্রেডিটকার্ড, সবই ঠিক আছে। অভাবে মানুষের স্বভাব নষ্ট হয়।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখি উনিশটা মিসডকল। বেশ রাত করে ঘুমিয়েছিলাম, তাই টের পাইনি। তাছাড়া আজ শুক্রবার, আমার আলসেমীর দিন। এতো ভোরে কে কল দিয়েছে? কল ব্যাক করতেই কম বয়সী একটি ছেলে সালাম দিলো, "রুবেল ভাইয়া, আমি কায়সার। আমি ফাহিম ভাইয়ার মেসের রুমমেট।" আমি কায়সার নামের অপরিচিত একটা ছেলের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। আনমনেই আমার চোখ চলে গেলো টেবিলের উপর। নোংরা চায়ের কাপটায় দুইটা লাল পিপঁড়া বসে আছে। এই চায়ের কাপেই গতকাল সন্ধ্যায় চুমুক দিয়েছিলো ফাহিম, আমার বন্ধু ফাহিম। আজ সে আর নেই এই পৃথিবীতে। গতরাতেই জীবনের সাথে সব খেলা শেষ করে চলে গেছে অন্য জগতে।
ফাহিমের মা'কে ফাহিমের লাশটা দেখাতে পারিনি। আজিমপুর গোরস্থানে দাফন হয়েছে ফাহিমের। ফাহিমের মা কিডনী হাসপাতালের বেডে পরে আছেন। ডায়ালাইসিস করে রাখতে হচ্ছে উনাকে। দুইটা কিডনীই নষ্ট উনার। প্রতিমাসে হাজার হাজার টাকা লাগে চিকিৎসার জন্য। ছোট তিনটা ভাই বোন ফাহিমের। একমাত্র অবলম্বন ছিলো তাদের বড় ভাই। কান্নায় ভেঙে পরেছে ওরা। আমার শান্তনা দেয়ার ভাষা ছিলোনা ওদের। বাড়ি ভর্তি গিজগিজ করছে মানুষ।
সবারই আফসোস, এই বয়সেই কেন আত্মহত্যা করলো ফাহিম! আমি একটু বসার জন্য ফাহিমের ঘরে ঢুকলাম। ঘর বোঝাই বই। ফাহিম পড়তে ভালোবাসতো। পড়ার টেবিলের সামনে পুরোনো দিনের ফ্রেমে ঘোলা কাচের নীচের ছবিতে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে দুই কিশোর। আমি আর ফাহিম। আমাদের দু'জনের হাতেই প্রাইজ।
স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রথম হয়ে পুরস্কার পেয়ে কি অদ্ভুত হাসি আমাদের চোখে। আমি আজ একাই বসে আছি ছবির সামনে। ফাহিম জীবনের কাছে হার মেনে চলে গেছে অনেক দূরে.... বহুদুরে.... অদ্ভুত কিছু কষ্ট বুকে নিয়ে। কিন্তু আমার চোখের সামনের ছবিতে যে কিশোর ফাহিম অবাক চোখে তাকিয়ে আছে, আজ চলে যাওয়ার পর বুঝতে পারছি, কি নিদারুন ব্যথা সয়ে সয়ে নির্লজ্জ হয়েছিলি তুই! যদি পারিস, ক্ষমা করে দিস সেই ছোটবেলার মতো! ক্ষমা করে দিস বন্ধু ভেবে!!!