'মুখোশ যখন মুখোশ পরে'
পাশের সীটে বসা লোকটা বারবার আগ্রহ নিয়ে হাসিবের দিকে তাকাচ্ছে৷ হাসিব সেটা খেয়াল করছে কিন্তু পাত্তা দিচ্ছে না৷ এতো লম্বা জার্নি, তাই হয়তো লোকটা কিছু একটা বলে কথাবার্তা শুরু করতে চায়। হাসিব বামদিকের সারিতে জানালার পাশে বসেছে, তার ঠিক পাশেই লোকটা। তার বয়স আনুমানিক ত্রিশ হবে। মুখে ঘন-কালো চাপদাড়ি। পরনে পরিষ্কার সাদা-শার্ট আর কালো-প্যান্ট। দেখতে কর্পোরেট অফিসারের মতো লাগছে। (সেরা থ্রিলার গল্প)
হঠাৎ ডানপাশের সারিতে একজন মাঝবয়সী মহিলা বিশ্রী আওয়াজ করে পলিব্যাগে মুখভর্তি বমি করা শুরু করলো। হাসিব নাক উঁচু করে জানালার বাইরে তাকালো দ্রুত। পাশে বসা লোকটা এবার হাসিবের দিকে তাকিয়ে মুখ খুললো, বুঝলেন ভাই, এইসব মানুষ বাসে উঠে বমি করতে করতে মরে যাবে, তাও বাস জার্নি এড়িয়ে চলবে না। ট্রেনেও তো যেতে পারে! আজব।
হাসিব ভদ্রতার খাতিরে লোকটার দিকে তাকিয়ে জোর করে একটু হাসলো শুধু।
কিন্তু এই কর্পোরেট সাহেবের বাঁধ খুলে গেছে এবার। সে আর চুপ থাকবে না। সরল হাসি দিয়ে বললো, ভাই আমার নাম টিপন আকন্দ। আপনি?
হাসিব কর্পোরেট সাহেবের বাড়িয়ে রাখা হাতে হাত মিলিয়ে বললো, হাসিব রেজা।
হাসিব একটা ব্যাপার খেয়াল করেছে। যে মহিলাটা কিছুক্ষণ আগে বমি করলো, তার ঠিক পাশেই একটা ২২-২৩ বছরের মেয়ে বসেছে। সে বেশ কয়েকবার কর্পোরেট সাহেবের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। মাঝেমধ্যে হাসিবের দিকেও আড়চোখে তাকাচ্ছে। বিভ্রান্তিকর দৃষ্টি।(থ্রিলার বই রিভিউ)
টিপন আকন্দ কথার চাকা সচল করলো, তো মি. হাসিব, আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
হাসিব একগালে হেসে বললো, এই বাসের সকল যাত্রীই সম্ভবত কক্সবাজার যাবে। কক্সবাজারের গেটলক এটা। আপনি অন্যকোথাও যাচ্ছেন বুঝি?
কর্পোরেট সাহেব একটু ইতস্ততভাবে বললো, না না, ভাই। তাহলে তো ভালোই হলো। গল্পগুজব করতে করতে যাওয়া যাবে। লং জার্নিতে আমি চুপচাপ থাকতে পারি না। চুপ করে থাকলে মহিলাদের মতো বমিবমি ভাব হয়। জানেন, একবার চুপচাপ বসে থাকতে থাকতে ঝামেলা হয়ে গেলো। জানালা দিয়ে মাথা বের করে ওয়াক করে ছেড়ে দিয়েছিলাম একজনের মাথার উপরে। সে ছিলো আবার পুলিশ। কি ভয়ংকর কাণ্ডটাই না ঘটিয়েছিলাম! আচ্ছা, আপনার বয়স কতো ভাই?
হাসিব ভ্রু কুঁচকে গলা টেনে উত্তর দিলো, প্রায় চব্বিশ। কেনো?
না, এমনিই। তাহলে আপনি আমার জুনিয়রই হবেন। তুমি করে বলি? জুনিয়রদের আপনি আপনি করতে ভালো লাগে না।
জি, বলতে পারেন।
যথেষ্ট গরম পড়েছে, তবুও হাসিব জানালার গ্লাসটা টেনে লাগিয়ে দিলো। বাইরে প্রচণ্ড ধুলোবালি। এবার হাসিব কন্ডাক্টরকে ডেকে বললো মাথার উপরের ফ্যানটা ছেড়ে দিতে। কিন্তু কন্ডাক্টর কড়া গলায় জবাব দিলো, চলতি গাড়িতে ফ্যান ছাড়া যাইবো না, বইসা থাকেন চুপচাপ। অতো ক্যাচাল কইরেন না। হাসিব নম্রতা বজায় রেখে আরো বেশ কয়েকবার বুঝিয়ে বললো, কিন্তু কাজ হলো না। পাত্তাই দিলো না। তখন কর্পোরেট সাহেব কন্ডাকটরের দিকে আচমকা চিৎকার করে উঠলো, ওই ব্যাটা বান*দ, প্যাসেঞ্জারদের ভোগান্তি হইলে বাস তোর *** দিয়া ভইরা দিমু। ভদ্র ভাষায় কইলে বুঝস না কিছু। এক্ষনি ফ্যান ছাড়।
মজার ব্যাপার হলো, ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যেই হাসিবের মাথার উপর ফ্যান ঘুরতে শুরু করলো।
কর্পোরেট সাহেব এবার একটু নড়েচড়ে বসে জিজ্ঞেস করলো, তো কক্সবাজারে কেন যাচ্ছো? ঘুরতে? নাকি বিশেষ কোনো কাজে?
হাসিবের চোখমুখ থেকে বিরক্তিটা এবার উধাও হয়ে গেলো। সে সাবলীলভাবে উত্তর দিলো, মূলত ঘুরতেই যাচ্ছি৷ তবে ঘুরতে যাওয়ার পেছনে একটা কারণ আছে অবশ্য।
টিপন আকন্দ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রইলো হাসিবের দিকে।
আমি আসলে লেখক হতে চাই। কয়েকবছর যাবৎ লিখে যাচ্ছি নিয়মিত। ভালোই চলছিলো। কিন্তু সমস্যাটা দেখা দিলো গত দু'মাস ধরে। কিছুই লিখতে পারছি না আজকাল। ব্যাপারটা আমার ভাইয়াকে জানানোর পরে সে-ই বললো, একটু বাইরে থেকে ঘুরে-টুরে আয়। সারাদিন ঘরকুনো হয়ে বসে থাকলে মস্তিষ্ক খুলবেই কীভাবে!
এভাবে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাদের গল্পগুজব বাসের গতির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে থাকলো। পুরো রাস্তা বকবক করেছে দুজন মিলে। হাসিবও পরে আর বিরক্তবোধ করেনি। মাঝেমধ্যে ওপাশের মেয়েটার চোখের দৃষ্টিতে আটকে যাচ্ছিলো শুধু। তবে মুগ্ধতায় নাকি কৌতুহলে কে জানে! মুগ্ধ হলেও ব্যাপারটা অস্বাভাবিক হবে না৷ মেয়েটা দেখতে অসম্ভব রূপবতী।
ভোরবেলায় কক্সবাজারে নামার পর বিদায়কালীন কথাবার্তা শেষ করে যে যার মতো চলে যাচ্ছে। আর ওই মেয়েটা দূরে দাঁড়িয়ে তাদের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টি রেখে চলেছে৷ হাসিব অবশ্য বাসে টিপন সাহেবকে জিজ্ঞেস করেছিলো, এই মেয়েকে চিনে কিনা। টিপন সাহেব ঠোঁট উল্টিয়ে দু'দিকে মাথা নেড়েছিলো।
হাসিব বেশ পরিপাটি একটা হোটেলে রুম নিয়েছে। এই হোটেলের ম্যানেজার ওর ভাইয়ার পরিচিত। থার্ড ফ্লোরে ১০৬ নাম্বার রুম। সিঁড়ি বেয়ে থার্ড ফ্লোরে উঠেই সে থমকে দাঁড়ালো! বাসের সেই মেয়েটা তার ঠিক উল্টো দিকের রুমটায় ঢুকে গেলো, আর মেয়েটাকে এগিয়ে দিয়ে পাশের রুমে ঢুকলো সেই কর্পোরেট সাহেব। মানে টিপন আকন্দ! হাসিব বেশ অবাক হলো। বেশ কিছু প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকলো মাথার ভেতর। যাহোক, হাসিব তার রুমে চলে গেলো। ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করলো। তারপর ক্লান্তি দূর করতে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে একটা লম্বা ঘুম দিলো।
হাসিবের ঘুম ভাঙলো দুপুরে। চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে বাথরুমে গিয়ে গোসল করলো। তারপর খাওয়াদাওয়া শেষ করে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলো। ঘড়িতে তখন বিকেল তিনটা। এতো লম্বা জার্নির ক্লান্তি অনেকটাই কেটে গেছে। এবার সে বেরুনোর প্রস্তুতি নিলো।
হাসিব সমুদ্রসৈকত ধরে আপন মনে হেঁটে বেড়াচ্ছে।
সমুদ্রসৈকতে এর আগেও দু'বার এসেছে সে। হয়তো দু'শ বার আসলেও সমুদ্রের প্রতি তার ভালোবাসা বিন্দুমাত্র কমবে না। সমুদ্রের প্রবল বাতাসে নিজেকে মুক্ত করে দিয়ে মুহূর্তেই সে প্রাণবন্ত হয়ে উঠে। সমুদ্র থেকে ছুটে আসা প্রত্যেকটা ঢেউকে তার ভীষণ আপন মনে হয়। আর রাত্রিবেলায় সমুদ্রের গর্জন তার নেতিয়ে পড়া স্বপ্নগুলোর প্রাণ ফিরিয়ে দেয়। হাঁটতে হাঁটতে হাসিবের দৃষ্টি গেলো সেই মেয়েটার উপর। মেয়েটা এখানেও! সাথে আছে কর্পোরেট সাহেব। হাসিব পাত্তা না দিয়ে নিজের মতো চলে যাচ্ছিলো, কিন্তু টিপন সাহেব তাকে দেখা মাত্রই গলা উঁচু করে ডাকলো।
হাসিব কাছে যেতেই টিপন সাহেব বলতে শুরু করলো, আরে হাসিব! আবার দেখা হয়ে গেলো তোমার সাথে।
হাসিব আনুষ্ঠানিকতার হাসি হেসে মাথা নাড়লো শুধু। (মৌলিক থ্রিলার pdf)
টিপন সাহেব মেয়েটার দিকে ইঙ্গিত করে বলতে লাগলো, ওহ্ ভালো কথা, ওর নাম নিঝুম। হোটেল খোঁজার সময় দুজনের দেখা হলো। তারপর একই হোটেলে রুম বুক করলাম।
হাসিব মেয়েটার সাথে হাই-হ্যালো শেষ করে বললো, আমিও তো একই হোটেলে উঠেছি। হোটেলে ঢুকে আপনাদের দেখলাম রুমে ঢুকছেন। অবশ্য আমার রুম আগে থেকেই বুক করে রেখেছিলো ভাইয়া।
টিপন সাহেব বেশ অবাক হয়ে বলে উঠলো, ওয়াও, হোয়াট আ সারপ্রাইজ! তাহলে তো ভালোই হলো, আড্ডা দেয়া যাবে জমিয়ে।
হাসিবের কাছে ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগছে। সবকিছু গোলমেলে। যাহোক, গল্প করতে করতে তিনজন মিলে হাঁটাহাঁটি করছে সমুদ্রসৈকত ধরে। মেয়েটাকেও বেশ গল্পপ্রিয় মনে হলো।
তারপর চারদিন কেটে গেলো। রোজরোজ তারা সমুদ্রসৈকত ধরে হেঁটে বেড়ায়। গল্প করে। ভাব জমায়। প্রতিটা সূর্যোদয় কিংবা সূর্যাস্তের সাক্ষী হয়ে থাকে তারা। নিঝুম এবং হাসিবের মধ্যে গড়ে ওঠে সুসম্পর্ক। আর কর্পোরেট সাহেব বনে যায় তাদের বড়ভাই। গতকাল বিকেলে নিঝুম হাসিবকে প্রেম নিবেদন করে, হাসিবও ফেরাতে পারেনি। তাকে গ্রহণ করে নেয় ভালোবাসার মানুষ হিসেবে। তাদের এই সম্পর্কে কর্পোরেট সাহেবও বেশ খুশি।
সমুদ্রসৈকতের সূর্যাস্তটা ভয়ংকররকম সুন্দর। তারা তিনজন চুপচাপ বসে সূর্যের ডুবে যাওয়া দেখছে। হঠাৎ নিঝুম বলে উঠলো, হাসিব, আমার একটা বিশেষ ইচ্ছে আছে।
হাসিব নিঝুমের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
নিঝুম বললো, আমি সমুদ্রসৈকতের একটা গভীর রাত উপভোগ করতে চাই। চারপাশে নির্জনতা ছড়িয়ে থাকবে। সমুদ্রের ঢেউ এসে আমাদের পা ছুঁয়ে যাবে। আকাশে পূর্ণ চাঁদ, সমুদ্র থেকে ছুটে আসা প্রবল বাতাস, আমার উড়ন্ত খোলা চুলে তোমার মুগ্ধতা। আর ভয় কাটানোর জন্যে একজন পাহারাদার।
নিঝুমের কথা শেষ হতেই টিপন সাহেব হেসে ফেললো। বললো, পাহারাদারটা কে?
মাঝখানে হাসিব কথা জুড়লো, কে আবার! বড় ভাইয়ের চেয়ে শক্তিশালী পাহারাদার কি আর থাকতে পারে?
নিঝুম বলে উঠলো, একদম একদম। হাসিব ঠিকই বলেছে। আপনিই দূরে বসে পাহারা দিবেন আমাদের। ভয়ের কিছু নেই। এখানে মশা নেই। কারো রক্তের অপচয় হবে না।
রাত প্রায় দু'টো বাজে৷ তিনজন মিলে হেঁটে বেড়াচ্ছে সমুদ্রসৈকত ধরে। এদিকটায় কোনো মানুষজন নেই। পুরোপুরি জনমানবহীন আফ্রিকার কোনো নির্জন দ্বীপের মতো। সমুদ্রের প্রবল বাতাসে তারা উড়ে যাচ্ছে যাচ্ছে অবস্থা। ঢেউ ছুটে আসার শব্দটা ভেতর কাঁপিয়ে তুলছে। কিছুদূর এগুনোর পর দেখতে পেলো কয়েকটা কুকুর একটা মৃত প্রাণীকে টেনেহিঁচড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে আর ঘেউঘেউ করছে। এটা দেখে নিঝুম টিপন সাহেবকে জিজ্ঞেস করলো, প্রাণীটা কী হতে পারে বলেন তো?
টিপন সাহেব মুচকি হাসলো। গলা ঝেড়ে উত্তর দিলো, কি জানি! বোঝা যাচ্ছে না।
হাসিব বিরক্তির সুরে বললো, কীসব নিয়ে কথা বলো তোমরা!
নিঝুম আর টিপন সাহেব মুচকি হাসলো শুধু।
নিঝুম হাসিবকে আহ্লাদী গলায় বললো, একটা কবিতা শোনাও না?
হাসিব কিছুক্ষণ চুপচাপ হেঁটে কবিতা ধরলো-
'এই যে মুহূর্তে, এই যে দাঁড়িয়ে থাকা–
এর কোনো অর্থ নেই ।
ঝর্নার জলে ভেসে যায় সম্রাটের শিরস্ত্রাণ ।
কমলার কোয়া থেকে খসে পড়া বীজ
ঢুকে পড়ে পাতাল গর্ভে ।
পোল্কা ডট্ দুটি প্রজাপতি তাদের আপন আপন কাজে ব্যস্ত।
বাবলা গাছের শুকনো কাঁটাও দাবী করেছে প্রকৃতির প্রতিনিধিত্ব।
সব দৃশ্যই এমন নিরপেক্ষ।'
টিপন সাহেব প্রশংসার সুরে বলে উঠলো, বাহ্! কি দারুণ! যদিও আগামাথা কিছু বুঝিনি। তোমার লেখা নাকি?
হাসিব মাথা হেসে বললো, না, সুনীলের।
হঠাৎ নিঝুম বলে উঠলো, ঐ দেখো তো, ওরা এদিকে আসছে না?
হাসিব মাথা নাড়িয়ে বললো, হ্যাঁ, তাই তো মনে হচ্ছে।
চারজন মানুষের অবয়ব। বিপরীত দিক থেকে এগিয়ে আসছে। চাঁদের আলোয় আকৃতি ছাড়া আর কিছু বোঝা যাচ্ছে না।
টিপন সাহেব নিঝুমের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো, হয়তো তারাও আমাদের মতো সমুদ্রসৈকতের নিস্তব্ধ রাত উপভোগ করতে বের হয়েছে।
কিন্তু ধারণা ভুল। চারটে মুখোশধারী শক্তিশালী যুবক তাদের সামনে এসে দাঁড়ালো, আর কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই তারা জোরজবরদস্তি করে হাসিবের হাত-পা-মুখ বেঁধে ফেললো। নিঝুম আর টিপন পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। তারা একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো শুধু। টিপন মুখোশপরা ছেলে গুলোকে প্রশংসার সুরে বললো, ওয়েল ডান, বয়েজ!
চারপাশে কেউ নেই। এই নির্জন সমুদ্রসৈকতের বালিতে হাসিবকে হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখা হলো। কিন্তু কেনো?
টিপন ধীরেসুস্থে হাসিবের কাছে গিয়ে মাথা নুইয়ে ভারী কন্ঠে বললো, ইউ আর ইন ট্র্যাপ, ম্যান! ফাঁদে পড়েছো।
মুখের বাঁধনটা খুলে দেওয়ার জন্যে মুখে উঁউঁ আওয়াজ করে হাসিব মাথা ঝাঁকাতে লাগলো। টিপন মুচকি হেসে খুলে দিলো বাঁধনটা।
হাসিব কিচ্ছুক্ষণ জোরে জোরে দম নিয়ে বললো, কিন্তু কেনো?
কোনো কারণ নেই। মানুষ কাটাকুটি করতে ভালো লাগে আমাদের। রক্ত ভালো লাগে। কলিজা, ফুসফুস। আহা! টিপনের কথা গুলো কেমন ভয়ংকর শোনালো। (মেডিকেল থ্রিলার)
নিঝুম ছেলেগুলোর কাছ থেকে একটা ধারালো ছুরি নিলো। ধীরেসুস্থে হেঁটে এসে হাসিবের পাশে বসলো। এখন তার চোখে মায়া নেই, অন্ধকারে বিড়ালের চোখে আলো পড়লে যেমন দেখায়, সেরকম দেখাচ্ছে।
টিপন সাহেব বলতে লাগলো, হাসিব, তুমি বেশ বোকা আছো। তোমার আগেই বোঝা উচিত ছিলো যে একটা মেয়ে এভাবে একা হোটেলে এসে থাকবে না। এতো সহজে প্রেমে পড়ে দিওয়ানা হয়ে যাবে না। তাছাড়া সেই বাস থেকে একসাথে, তার উপর হোটেলেও একসাথে রুম নেয়াটা কোনো কোইন্সিডেন্স হতে পারে না। বোকা ছেলে!
তখন হাসিব কাকুতিমিনতি করতে শুরু করলো, প্লিজ আমাকে মারবেন না। আপনাদের যা চাই, তাই দেবো আমি।
হাসিবের কথা শুনে চুপ হয়ে গেলো টিপন। হঠাৎ পাক্কা অভিনেতার মতো হেসে ফেললো সে। তারপর তাড়াহুড়ো করে নিজেই হাসিবের বাঁধন খুলে দেয়ার জন্যে উঠে-পড়ে লাগলো। নিঝুম হাসিবকে টেনে তুললো। ছেলেগুলো পাশেই রোবটের মতো দাঁড়িয়ে আছে।
টিপন সাহেব হাসিবকে মুক্ত করে দিয়ে বললো, হাসিব, তুমি ঠিক আছো তো? এটা একটা সাজানো নাটক ছিলো। আমি সব খুলে....
টিপনকে থামিয়ে দিয়ে হাসিব শব্দ করে হাসতে শুরু করলো। হাসির ভয়ানক আওয়াজে চারপাশটা কেমন ভূতুড়ে হয়ে উঠেছে।
হাসিব হাসি থামিয়ে টিপন সাহেবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলতে লাগলো, কী খুলে বলবেন আপনি? আপনি যে ভাইয়ার অফিসে চাকরি করেন, সেটা আমি জানি। এই সবকিছু আমার ভাইয়ার প্ল্যান অনুযায়ী হয়েছে, এবং আপনাকে এইসব করার জন্যে মোটা অংকের টাকা দেয়া হয়েছে, তাই তো? তারপর? নিঝুমকে আমার নকল প্রেমিকা বানানো হয়েছে। হোটেলের তিনটা রুম আগে থেকেই বুক করে রেখেছিলো ভাইয়া। সবকিছু প্রি-প্ল্যান্ড ছিলো। আর এগুলো কেনো করা হয়েছে? কারণ আমার স্বপ্ন আমি লেখক হবো। কিন্তু ইদানীং আর লিখতে পারছিলাম না। তাই ভাইয়া আমাকে তাগিদ দিয়ে কক্সবাজার পাঠালো এবং এই নাটকটা সাজালো। যাতে আমার বাস্তবে নতুন একটা ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হয় এবং আবার লেখালেখি শুরু করতে পারি। তাই তো? হা হা হা! হাস্যকর!
এবার টিপন সাহেব ঘাবড়ে গেলো। জড় পদার্থের মতো দাঁড়িয়ে আছে। তৎক্ষনাৎ সেই ছেলে গুলো এসে এবার তাকে শক্ত বেঁধে ফেললো। জোরজবরদস্তি করেও কোনো লাভ হলো না।
টিপন সাহেবের মুখ বাঁধা। বালিতে পড়ে গোঙাচ্ছে শুধু। এবার হাসিব আর নিঝুম তার পাশে গিয়ে বসলো। আচমকা নিঝুম 'শুয়ো**বা**' বলে গালি দিয়ে একের পর এক ঘুষি মারতে শুরু করলো। হাসিব নিঝুমকে থামিয়ে দিয়ে মুখটা টিপন আকন্দের কাছে নিয়ে বললো, বোকা আমি নই। সত্যিকারের বোকা তুই। অবশ্য অপরাধীরা একবার না একবার বোকামো করবেই। হয়তো আরেকটা অপরাধ করতে গিয়ে, না হয় লোভে পড়ে। তোকে কেটে টুকরো টুকরো করার আগে জেনে রাখ, এই পুরো প্ল্যানটাই আমার। কিছুই আমার অজানা ছিলো না। আমি ভিক্টিম নই। ভিক্টিম তুই।
নিঝুম বালির উপর পড়ে থাকা ছুরিটা হাতে নিতে নিতে বললো, মরার আগে একটা কথা জেনে যা, সেদিন রাতে রাস্তা হারিয়ে ফেলা ছোট্ট মেয়েটা আমার ছোটবোন ছিলো।
কথাটা শোনার পর টিপন কেমন থমকে গেলো। তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। তার চোখে ঘন-কালো অন্ধকার নেমে আসছে ধীরেসুস্থে।
লেখক- Linkon Hasan
সংগ্রহঃ বইপোকা গ্রুপ