সত্যি ভালোবাসার গল্প(বিবাগী)
গল্পকারঃ দিপ্র হাসান।
আমি পালাচ্ছি। মানুষ বাড়ি পালায়। স্কুল পালায়। দেশ থেকে পালায়। আমি আমার থেকে পালাচ্ছি। এতদিনের আইডেন্টিটি, জব, সংসার সব ছেড়ে ভ্যানিস হয়ে যাচ্ছি।
আমাকে খুঁজছে র্যাব। তিনটি থানার দারোগা। একটি ব্যাংকের ম্যানেজার আর স্বঘোষিত আটজন পাওনাদার। আমার সন্তানদের কাছে আমি কাপুরুষ। স্ত্রীর ভাষায়, পরনারী আসক্ত।
শুরুটা বছর দুয়েক আগের এক হৈমন্তী সন্ধ্যায়। একটি মেয়ে এসেছে আমার স্ত্রীর সাথে। বলল, বান্ধবী। এক রুমে গল্প করছে ওরা। আমি লিখছি অন্য রুমে। পানি খেতে এক সময় রুম থেকে বের হই। শুনি, মেয়েটা বলছে,আমার প্রেম কাহিনী - সত্য প্রেমের গল্প
- ওর বউ তোকে সন্দেহ করে।
- করলই বা। কার কি তাতে?
- কারো সংসারে আগুন লাগানো কি উচিত হচ্ছে?আমার প্রেম কাহিনী - সত্য প্রেমের গল্প
- দেখ! তোরা আগে থেকেই ক্লোজ। এখন আমার সাথে ওর বন্ধুত্ব হওয়ায় জেলাসি থেকে এসব বলছিস! ওর বউ আমার ব্যাপারে কিছুতেই সন্দেহ করবে না। আমি ও রকম মেয়ে না।
ইদানীং একটা ফেতনা চালু হয়েছে দেশে। ফেসবুকের কল্যাণে। ব্যাচ ব্যাচ খেলা। কবে কোন আকালের বছর একসাথে এসএসসি দিয়েছে, সেই সুত্রে নতুন করে বন্ধুত্ব। সংসার গোল্লায় যাক। বন্ধুত্বই আসল।
এক একটা গ্রুপে লাখ লাখ সদস্য। সবাই সবার দারুণ বন্ধু। একজনের বিপদে অন্যরা এগিয়ে আসছে। কারো ক্যান্সার, টাকা লাগবে অনেক, বন্ধুরা মিলে জোগাড় করে দিচ্ছে। কাউকে পুলিশ ধরেছে। সবাই মিলে উদ্ধার করছে। কয়েকজন থাকে কমিটিতে। এরা দারুণ উদ্যমী। একের পর এক প্রোগ্রাম করে সবাইকে চাঙ্গা রাখে। আজ এই শহরে প্রোগ্রাম তো কাল অন্য শহরে।
আমার স্ত্রী দিনা। এমনই এক গ্রুপের সক্রিয় সদস্য। দেখতে যেমন তেমন, নাচে গানে সেই। নতুন করে পাওয়া বন্ধুদের নিয়ে এ শহর ও শহর করছে। আমি মধ্যবিত্ত কেরানী। বাসে চলাচল। ওর বন্ধুদের গাড়ি বাড়ি টাকা কড়ি অঢেল। আমি হীনমন্যতায় ভুগি। ওকে বলি, এসব বাদ দাও। সংসারে মন দাও। ও হুংকার ছাড়ে, বাচ্চারা কে কোন ক্লাসে পড়ে তাই তো জান না তুমি! আর আমাকে বলছ সংসারে মনোযোগী হতে?আমার প্রেম কাহিনী - সত্য প্রেমের গল্প
দুই বান্ধবী কথা বলেই যাচ্ছে। আমি উৎকর্ণ হয়ে শুনি। হঠাৎ কল আসে বউয়ের মোবাইলে। ওটা এখন আমার সামনে। তাকিয়ে দেখি, যে ছেলেটাকে নিয়ে দুইজনের বাকযুদ্ধ হচ্ছে তার কল। বউ দ্রুত এসে কল রিসিভ করে। ফোন কানে দিয়ে বলে, না না সমস্যা নেই। আরও কিছুক্ষণ ওপাশের কথা শুনে বলে, এখন রাখছি। পরে কথা হবে। আমি জিজ্ঞেস করি, কে কল দিয়েছিল? ও বলে, ছোট আপা।
রাতে ঘুমুতে গিয়ে জিজ্ঞেস করি মিথ্যে বলেছিলে কেন!ও উত্তর দেয়, নইলে মেয়েটা শুনে ফেলত। আমি বলি, ও তো অন্য রুমে ছিল। বউর ঝাঝালো উত্তর, তুমি কি সন্দেহ কর আমাকে? হ্যাঁ করি।
আমি ঘুরতে পছন্দ করি। পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল সবখানে। ভ্রমণসঙ্গী ব্যাগটি নিয়ে বাসা থেকে বের হয়েছি আজ। বউ জানে, অফিস শেষে রাতে পুকুরপাড়া যাচ্ছি। আর জানে বলেই জানি, রাতে আমাকে বাস থেকে নামিয়ে নিয়ে যাবে র্যাব অথবা পুলিশ।
অফিসে গেলাম না। গেলাম গাবতলী। শ্যামনগরের বাসে উঠে হানিফকে ফোন দেই। চার বছর আগে সুন্দরবন ঘুরতে গিয়ে ওর সাথে পরিচয়। সেদিন ছিল তুমুল বৃষ্টি। আমাদের লঞ্চ দুবলার চরের অদূরে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা ছোট্ট নৌকায় দুবলার চর নেমে শুটকি দেখছি। তখনি আকাশ কালো করে শুরু হল ঝড়ের তাণ্ডবনৃত্য।
তিনজন নারী সহ আমি আটকা পড়েছিলাম হানিফদের শুটকি ঘরে। সেই ঝড়ে আমরা যখন ভয়ে কাঁপছি, হানিফ অম্লান বদনে বাদাম ভেজে আমাদের খেতে দিল। আমি অবাক চোখে ওকে প্রশ্ন করলাম, এই ঝড়ে যদি সব ডুবে যায়? ও বলল, ডুববে না। এই সময়ের ঝড়ের অত দাপট থাকে না।
ঘড়ি ধরা তিন ঘণ্টা পর ঝড় থামল। এই পুরোটা সময় হানিফের সাথে গল্প করেছি আমরা। জেনেছি ওর সুখ দু:খের নানা কথা। তিন নারীর একজন, তিথি, হানিফকে বলেছিল, আমার খুব ইচ্ছে হয় এভাবে জেলেদের মত জীবন কাটাতে। হানিফ বলেছিল, পারবেন না। সাধক ছাড়া কেউ জেলে হতে পারে না। আপনার এমনিতে মনে হবে, মাছ ধরলাম, বিক্রি করলাম, খেলাম। ব্যস- জীবন পার হয়ে গেল। কিন্তু বিষয়টা অত সহজ না। (আমার প্রেম কাহিনী - সত্য প্রেমের গল্প)
ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার হয়ে যাবে জালে একটাও মাছ পড়বে না। দিনের পর দিন কোন মাছ পাবেন না। কখনো, যদি মাছ পান, বিক্রি করতে গিয়ে দেখবেন ক্রেতা নাই। সবার মাছ বিক্রি হয়ে যাচ্ছে আপনারটা কেউ কিনছে না। বিক্রি হয়ত হল, সদাইপাতি করে বাড়ি এসে দেখবেন- অঘটন ঘটে গেছে। যে মেয়েটিকে ভালবাসতেন, সে অন্যের হাত ধরে পালিয়ে গেছে। আবার এই যে দেখেন, শীতের সিজনে আমরা এখানে আসি শুটকি করার জন্য। অথচ কী হল আজ? ঝড় এসে আমাদের স্বপ্ন ধুলিস্যাৎ করে দিয়ে গেল। (আমার প্রেম কাহিনী - সত্য প্রেমের গল্প)
আমি অবাক হয়ে হানিফকে দেখি। ঝড় ওর কত বড় সর্বনাশ করেছে বুঝতে পেরেও এমন শান্ত ছিল কিভাবে? যে বিপদকে এড়ানো সম্ভব না, তাকে মেনে নিয়ে কেমন শান্তভাবে মেহমানদারি করতে শুরু করেছে? জন্মের পর থেকেই দুর্যোগ মোকাবেলা করতে করতে কি এরা হয়ে যায় শক্ত নার্ভের মানুষ? মনে মনে হানিফকে গুরু মেনে বলি, আজ না হোক কাল, অল্প কিছুদিনের জন্য হলেও আমি তোমার জীবন যাপন করতে চাই। হানিফ মুচকি হেসে বলেছিল, জীবন বদল এত সহজ না গুরু! যখন মাদ্রাসায় যেতাম, স্বপ্ন দেখতাম বড় মাওলানা হব। তারপর যখন নদী ভাঙনে সব হারালাম, এই জীবনে অভ্যস্ত হতে অনেক কষ্ট হয়েছিল। তিন নারীর একজন, সায়ন্তী বলেছিল, হাসান ভাই! যদি আপনি এই জীবন শুরু করেন- আমাকে জানাবেন! আমিও অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও একেবারে ভেতর থেকে জেলে জীবন দেখতে চাই। (আমার প্রেম কাহিনী - সত্য প্রেমের গল্প)
হানিফকে নিজের পরিচয় দেয়ার পরও চিনতে পারেনি। যখন বললাম, একবার দুবলার চরে তোমার শুটকি ঘরে তিনটা মেয়ে আর একটা ছেলে ঝড়ে আটকা পড়েছিল...ও মনে পড়েছে- বলে চিৎকার করে উঠল হানিফ। আরে গুরু এতদিনে মনে পড়ল আমাকে? কই আছেন এখন? আবার সুন্দরবন ঘুরতে আসতেছেন নাকি? আমি শান্ত গলায় হানিফকে বলি, তোমাকে খুব দরকার আমার। আমি রাতের মধ্যে শ্যামনগর পৌঁছে যাব। কিছুদিন জেলে হিসেবে জীবন যাপন করতে চাই। হানিফ উত্তর করল, আগামীকাল ভোরে আমরা সুন্দরবন ঢুকব। আপনি কি আমাদের সাথে যাবেন? যাব মানে? আলবৎ যাব। তুমি একজনের খোরাকি বেশি নাও। (আমার প্রেম কাহিনী - সত্য প্রেমের গল্প)
বউকে সন্দেহ করায় খুব চিৎকার চেচামেচি করে। আমি রেগে ওর হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নেই। ফেসবুকে ওর আইডিতে ঢুকে সবগুলো গ্রুপ থেকে লিভ নেই। শাশুড়িকে ফোন করে মেয়ের গোপন অভিসার সম্পর্কে জানাই। ওই ছেলেকে ফোন দিয়ে শাসিয়ে দেই। বউ এবার নরম হয়। গ্রুপ এবং নতুন তৈরি হওয়া ছেলে বন্ধুদের থেকে দূরে থাকার আশ্বাস দেয়। ধীরে ধীরে সব স্বাভাবিক হয়ে আসতে টের পাই, ছেলেটির সাথে তার সম্পর্ক আরও স্বাভাবিক হয়েছে। এবার ওর বউ সহ আমাদের বাসায় আসে। এক সাথে ট্যুরে জয়েন করে। তারপর এক পবিত্র ভোরে ওদের চ্যাট নজরে আসে। একজন বলছে, খুব ভালবাসি তোকে! অন্যজন বলছে, বিশ্বাস করি না। অপরজন বলছে, কিভাবে বিশ্বাস করাব?
নাহ এগুলোও সন্দেহ করার মত কিছু না। এসব হর হামেশাই অনেকে অনেককে বলে থাকে। এর মানে এই নয় যে, নিজের সংসার ছেড়ে তার সাথে ভেগে যাবে। সুতরাং এসব নিয়ে আমার উচ্চবাচ্য করা উচিত হবে না। কিন্তু আমি যে চিরকালের গাড়ল! উচ্চবাচ্য করলাম। শুধু উচ্চবাচ্য না, মারধরও করলাম। আর বউয়ের বন্ধুদের রোশানলে পড়লাম। (আমার প্রেম কাহিনী - সত্য প্রেমের গল্প)
আমার ব্যাংক চেকে সিগনেচার জাল করে বন্ধুদের দিয়ে দিল সে। সেই চেক বাউন্স করিয়ে আমার নামে মামলা হল। চেক ডিজঅর্নারের সাথে ফ্রড মামলা। ব্যাংক লোন নিয়ে ফ্ল্যাট কিনেছিলাম, ওটার কিস্তি বাকি পড়ল বারোটা। মাসের শুরুতে বউকে যে খরচ দিতাম তাতে ব্যাংকের কিস্তির টাকাও থাকত। গত বারো মাস সেই টাকাও জমা দেয়নি। ব্যাংক থেকে নোটিশ এল, কিস্তির টাকা না দিলে ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিবে। বউ দিল নারী নির্যাতনের মামলা। (আমার প্রেম কাহিনী - সত্য প্রেমের গল্প)
হঠাৎ দার্শনিক হয়ে গেলাম। কার জন্য এত কষ্ট করছি? কী লাভ এই জীবন যাপন করে? ওরা যদি আমাকে ছাড়া ভাল থাকে- আমার কি ঠ্যাকা পড়েছে ওদের সুখের ঘরে আগুন দেয়ার। তারচেয়ে আমিই চলে যাই অন্য পথে। যে পথে কখনো কেউ যায় না!
সুন্দরবনের গহীনে শত সহস্র খাল। এ খাল ও খাল করে সন্ধ্যা নাগাদ একটা বড় খালে পৌঁছি। খালে বাঁশের লম্বা লগি পুতে তার সাথে নৌকা তিনটা বাঁধা হয়েছে। একটা নৌকা হানিফের বাকি দুটো ওর কাজিনদের। এক নৌকায় রাতের খাবারের আয়োজন হচ্ছে। আরেক নৌকায় শুরু হয়েছে গানের আসর। হানিফ আমার কানে কানে বলে, সুন্দরবনের গহীনে একটা গোপন শহর আছে। যাবেন? যাব মানে? অবশ্যই যাব। (আমার প্রেম কাহিনী - সত্য প্রেমের গল্প)
হানিফ কাজিনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমাকে আরো কিছু এলাকা ঘুরিয়ে দেখানোর কথা বলে নৌকা ছেড়ে দিল। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। লাখ লাখ পাখির কাকলিতে আকাশ মুখরিত হচ্ছে। হানিফের ইঞ্জিন চালিত নৌকা সুন্দরবনের আরও গহীনে প্রবেশ করতে থাকল। তারপর এক সময় যখন চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, দূরে সারি সারি আলো দেখতে পেলাম।
খালের উভয় পাশে শত শত নৌকায় জ্বলছে আলো। কোনটায় হ্যাজাক, কোনটায় হারিকেন, কোনটায় কুপি। চার্জার বাল্বও জ্বলছে কোন কোনটায়। হানিফ জানায়, সভ্য দুনিয়ার সব সুখ এখানে পাওয়া যায়। দেশ বিদেশের অনেক পর্যটক এখানে আসে। বাংলাদেশ এবং ভারত সরকারের কাছ থেকে দশ বর্গমাইলের এই জায়গাটা একশ বছরের জন্য লিজ নিয়েছে একটা আন্তর্জাতিক সংস্থা। তারাই চালায় শহর। দুুনিয়ায় যত নিষিদ্ধ শহর আছে তার মধ্যে এটি একটি। সন্ধ্যা হলেই জেগে ওঠে। ঘুমিয়ে পড়ে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে। (আমার প্রেম কাহিনী - সত্য প্রেমের গল্প)
গাছের ডালে নৌকা বেঁধে নেমে পড়ে হানিফ। আমি ওকে অনুসরণ করছি। টর্চ জ্বালিয়ে জঙ্গলের পথ ধরে এগুচ্ছে ও। হাঁটতে হাঁটতে আরেকটা খালে গিয়ে পৌঁছলাম। এখানেও সারি সারি নৌকা বাঁধা। তবে এগুলোয় আলো নাই। যেন নিষিদ্ধ শহরের মধ্যে আরেকটি নিষিদ্ধ এলাকা। কয়েকটা নৌকায় টর্চের আলো ফেলে অবশেষে একটা নৌকার দিকে পা বাড়ালো হানিফ। আমিও ওর পেছন পেছন পা বাড়ালাম।
আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে নৌকার ভেতর আলো জ্বলল। দুজন এক সাথে ভেতরে ঢুকলাম। এক জলকন্যা সল্পবসনা হয়ে বসে আছে। আমাকে দেখিয়ে হানিফ বলল, বড় কুটুম্ব। খাতির যত্ন কর। মেয়েটা একটা বোতল আর দুটো গ্লাস এগিয়ে দেয়। আমি হানিফের দিকে তাকাই। হানিফ বলে, খান গুরু! মন ভাল হয়ে যাবে।
নৌকায় আসতে আসতে আমার ফেরারি হওয়ার গল্প বলেছিলাম ওকে। এত বছরের সংসার, চেনা জীবন, চেনা মানুষ ছেড়ে আসা এত সহজ না। জীবন বদলের কষ্ট হানিফ বোঝে। তাই নিয়ে এসেছে এই নিষিদ্ধ শহরে! আমি যেন কোনো হতাশ আত্মা, হানিফ যেন এক পরী আর এই নিষিদ্ধ শহর যেন স্বপ্নের কোকাফ নগর।
কিছুক্ষণ পর আমাকে জলকন্যার জিম্মায় রেখে হানিফ বেরিয়ে যায়। মেয়েটির নাম শিরিন। বাড়ি মুন্সিগঞ্জ। বছরে দুই তিনবার আসে এখানে। সাধারণত বিদেশীদের সাথে রাত কাটায়। একেক রাতে চল্লিশ পঞ্চাশ হাজার ইনকাম হয়। কিন্তু আমি তো নিধিরাম সর্দার। আমার তো টাকা নাই। শিরিন হাসে। সমস্যা নাই। হানিফ ওদের নিয়মিত মাছ দেয়। ওর খাতিরে আমার সেবা যত্ন করবে ও। তাছাড়া বিদেশি কেউ জুটে গেলে ওই সময়টা আমাকে একা কাটাতে হবে এখানে। বিদেশী খাতির করার নৌকা আলাদা।
কখন ঘুমিয়েছি মনে নাই। কোন এক বিদেশীর ডাকে বের হয়েছিল শিরিন। আমি হানিফ অথবা শিরিনের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে এক সময় টুপ করে ঘুমের কোলে ঢলে পড়ি।
জেগে দেখি নৌকা চলছে। পাশে আমার ব্যাগ। এটা কি হানিফের নৌকা? মাথা তুলে দেখি শিরিন মিটিমিটি হাসছে। আমার অবাক চোখের দিকে তাকিয়ে শিরিন বলছে, হানিফ তোমাকে বিক্রি করে গেছে আমার কাছে। এখন থেকে তুমি আমার শৌহর। আমাকে চুপ থাকতে দেখে শিরিন আবার মুখ খোলে, আপনি হানিফকে ফোন দিয়েছিলেন না? সেই ফোনের লেজ ধরে পুলিশ আপনাকে খুঁজে বের করবে। তাই হানিফ আপনাকে সাথে রাখতে চায় নাই। আপনি রাজি হবেন না বলে চুপচাপ রেখে গেছে। আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি? জবাবে শিরিন হাত ইশারায় কাছে ডাকে। কাছে যেতে দূর দীগন্তে দাঁড়িয়ে থাকা একটা বিন্দু দেখায়। (আমার প্রেম কাহিনী - সত্য প্রেমের গল্প)
-কি ওটা?
-আন্ধারিয়ার মালকিনের জাহাজ।
-আন্ধারিয়া?
- রাতে যে শহরে ছিলেন ওটার নাম আন্ধারিয়া। এক মেক্সিকান মেয়ে ওটার সম্রাজ্ঞি। নাম, ভেলেন্তিয়া।
-ওখানে যাচ্ছি কেন?
- আমি এবং হানিফ দুজনই তার চাকরি করি।
- আমি যাচ্ছি কেন?
- বলেছি না, আপনাকে কিনেছি আমি। ভাল কথা, কাল রাতে কিছু না করেই ঘুমিয়ে গেলেন কেন? আমি এখন বুঝতে পারছি, কেন আপনার বউ অন্য পুরুষের দিকে হাত বাড়িয়েছে।
এ কথার কোনো জবাব হয় না। ওর থেকে একটু সরে পেছনে ফেলে আসা পথের দিকে তাকিয়ে থাকি। একটু পর শিরিন এসে দু-হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে, রাগ করেছেন? আমি জবাব দেই না। শিরিন ধীরে ধীরে নিজের কাহিনী বলতে শুরু করে। দু বছর বয়সে বাপকে হারিয়েছিল। অন্য লোকের সাথে ওর মার বিয়ে হয়। সেই লোকই একদিন ওকে বিক্রি করে দেয় ভিক্ষুক ব্যবসায়ীদের কাছে। চেহারা সুন্দর বলে তাদের কাছ থেকে কিনে নেয় আরেক লোক। তারপর নানা ঘাটে ঠেকতে ঠেকতে একদিন হয়ে গেছে জলকন্যা।
এ লাইনে শিরিন এখন মোটামুটি লিজেন্ড। দেশ বিদেশের বিখ্যাত কে কে এই শহরে এসেছে, তার কাছে এসেছে একে একে সব বলে গেল। আরও বলল, মানুষকে জানার জন্য এরচেয়ে ভাল কোন পেশা হয় না। প্রতিদিন নতুন নতুন মানুষের সাথে পরিচয় যেমন হয়, তেমনি তাদের হৃদয়ের অনেক গভীর কথাও জানা যায়। ধর্ম স্বীকৃতি দেয় না বলে এই পেশাকে খারাপ ভাবার কারণ নাই। তার দৃষ্টিতে পৃথিবীর মহত্তম পেশা এটি। (আমার প্রেম কাহিনী - সত্য প্রেমের গল্প)
জাহাজ থেকে মই ফেলা হল আমাদের জন্য। প্রথমে শিরিন তারপর আমি। ধীরে ধীরে দড়ির মই বেয়ে জাহাজে উঠে এলাম। এক বিদেশী মেয়ের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিল শিরিন। ভেলেন্তিয়া।
পৃথিবীর সকল সমুদ্রপথকে চোরা কারবারিরা পঞ্চাশ ভাগে ভাগ করে নিজেদের মধ্যে বন্টন করে নিয়েছে। উপমহাদেশীয় এই অঞ্চল পড়েছে ভেলেন্তিয়ার ভাগে। মেক্সিকোয় ওর মাদক, ক্যাসিনো আর নারীর ব্যবসা।সেখান থেকে সেরা সেরা জিনিস জাহাজে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় ও। স্থানীয় বড় বড় হোমরা চোমড়ারা আসে ওর সেবা নেয়ার জন্য। ব্যবসা বাড়াতে তৈরি করেছে অত্যাধুনিক এই শহর। আন্ধারিয়া।
সন্ধ্যার রক্তিম আলোয় সাগরের পানি লাল হয়ে গেছে। দড়ির মই বেয়ে নীচে নেমে যাচ্ছে শিরিন। ভেলেন্তিয়া আমার পাশে দাঁড়িয়ে। আমাদের দিকে হাত নেড়ে শিরিনের নৌকা ছেড়ে দেয়। কানের কাছে মুখ এনে ভেলেন্তিয়া জানতে চায়, প্রেমে মজেছিলে বুঝি? আমি হাসি। বিষন্ন। ম্লান।
ভেলেন্তিয়ার মুখোমুখি বসে আছি। এতক্ষণ আমার জীবন কাহিনী শুনেছে ও। চোখে পানি দেখে অবাক হয় মেয়েটা। বউকে এত ভালবাস? ভালবাসি কিনা জানি না। তবে ওর বিশ্বাসঘাতকতায় কষ্ট পেয়েছি খুব। ও এখানে বিশ্বাসঘাতকতার কিছু পায় না। মনের উপর তো জোর চলে না। যে কোন সময় যে কাউকে ভাল লাগতেই পারে।
আমি মেয়েটার দিকে তাকাই। রাজকীয় চাকচিক্যের ভেতরেও যেন কি এক গভীর বেদনা লুকিয়ে আছে। আমি এখানে কেন? জানতে চাই ওর কাছে। হানিফকে কয়েকজন বাংলাদেশি এমপ্লয়ি সাপ্লাইয়ের অনুরোধ করেছিলাম। ছেলেটা খুব বিশ্বস্ত। কিন্তু আমার ভবিষ্যৎ কি? আমি কি তোমাদের ক্রিতদাস? ও হাসে। ক্রিতদাসের সাথে কি কেউ এমন আচরণ করে?
ভেলেন্তিয়ার জাহাজ ভারত মহাসাগরের জলরাশি কেটে এগিয়ে যাচ্ছে। আমার দৃষ্টি ওর দুচোখে প্রবেশ করে। সেখানে একটি ছেলে আর মেয়ে পাশাপাশি সিটে বসা। মেয়েটার মাথা ছেলেটার কাঁধে। ওদের বাস চকোরিয়া পার হয়ে কক্সবাজারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ভেলেন্তিয়া বলছে, দুঃখ করো না। মেক্সিকান মেয়েরা দুনিয়ার সেরা। কোন অপূর্ণতা থাকবে না তোমার।
সংগ্রহ ঃ বইপোকা গ্রুপ