থ্রিলার_সুপারশপের_খুনি
লেখকঃ খোন্দকার মেহেদী হাসান
সুপার শপে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম আর কি কি কেনার কথা ছিল আমার। মিলি বেশ কয়েকবার বলেছে লিখে নিয়ে যাও, আমি শুনিনি। মাত্র চার পাঁচটা জিনিস কিনব সেটা আবার লিখে নিতে হবে কেন? মিলি কে গম্ভীর মুখে বলেছি, তুমি কি ভেবেছ আমার স্মৃতি শক্তি এই রকম খারাপ হয়ে গেছে যে এই সামান্য কয়েকটা জিনিস মনে রাখতে পারব না? নিজের স্বামী সম্পর্কে একটু উচ্চ ধারণা রাখ ভাই।
মিলি কথা না বাড়িয়ে একটা বাঁকা হাসি দিয়ে চলে গেছে। দেখে আমার মেজাজ আরও খারাপ হয়েছে। আমি নামগুলো মনে করতে করতে এসেছি। এই সুপারশপে ঢোকার সময়ও সবগুলো মনে ছিল। সেমাইয়ের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে বুঝলাম ভুলে গেছি কয়েকটার নাম। মিলিকে ফোন করে জিজ্ঞেস করব সেটাও প্রেস্টিজে লাগছে, মিলির সঙ্গে এত ভাব দেখান ঠিক হয়নি। কি করি ভাবছি এই সময় একটা পরিচিত গলার আওয়াজ শুনলাম।
--মেহেদী কি হয়েছে এইভাবে এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন? বাজারের লিস্ট ভুলে গেছ? এখন মিলিকে জিজ্ঞেস করতে ভয় পাচ্ছ?
তাকিয়ে দেখি গুলজার আংকেল। আমি একবার আশা নিয়ে আংকেলের দিকে তাকালাম। পুলিশের সাবেক ডি আইজি এই ভদ্রলোককে জাদুকর মনে হয় আমার, নিশ্চয়ই কোন উপায় সে বের করতে পারবে।
বললাম, আংকেল আপনি এইখানে? প্লীজ বলেন না মিলি আমাকে আর কি কি কিনতে বলেছিল?
গুলজার আংকেল হাসলেন, তুমি আমাকে কি মনে করো মেহেদী, মাইন্ড রিডার? নাকি জাদুকর? আমি কিভাবে জানব মিলি তোমাকে কি কি বাজার আনতে বলেছে? তুমি মনে করার চেস্টা কর, পারবে।
আমি হতাশ হলাম। সত্যি তো গুলজার আংকেল কিভাবে জানবে মিলি কি কি আনতে বলেছে।
আমি মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছি। মিলিকে ফোনই দিতে হবে, ইজ্জত এইবার শেষ। গুলজার আংকেল হঠাৎ হেসে বললেন, তুমি কোনো বিপদে পড়লে এতো হতাশ্ চেহারা কর সেটা আর বলার না। তোমার স্ত্রী খুবই ভাল মেয়ে আর কেয়ারিং। সে তোমাকে খুব ভালো মতোই চেনে। আমার বিশ্বাস সে বাজারের লিস্টটা তোমার মোবাইলে টেক্সট করে রেখেছে। চেক করে দেখ।
আমার চোখ মুখ উজ্জ্বল হলো। মিলি নিশ্চয়ই সেটা করেছে। বড্ড ভালো মেয়ে। কিন্তু এসএমএস চেক করে হতাশ হলাম। কয়েকটা ফালতু প্রমোশনাল মেসেজ এসেছে, মিলির কোন মেসেজ নেই।
আমি গুলজার আংকেলের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লাম, নেই।
উনি বললেন, মেসেঞ্জার, হোয়াটস এপও চেক কর।
আমি তাকিয়ে দেখি, মোবাইলের ডাটা অফ করা। অন করলাম, সাথে সাথে মেসেঞ্জারের মেসেজ রিসিভ হলো। খুলে দেখি মিলি ঠিকিই বাজারের লিস্ট মেসেজ করে দিয়েছে।
গুলজার আংকেল শব্দ করে হাসলেন, মিলি খুব বুদ্ধিমতি মেয়েও বটে, তুমি যাতে পরে অস্বীকার করতে না পার সেজন্য সে মেসেঞ্জারে পাঠিয়েছে, এখন সে দেখবে যে তুমি সেটা সীন করেছ মানে- বাজারের লিস্ট ভুলে গিয়েছিলে। হা হা।
আমি আবার মন খারাপ করে বাজার করতে লাগলাম। শেষ পর্যন্ত মিলিরই জিত হল, ধুর!
গুলজার আংকেল মিটি মিটি হেসে আমার পাশে পাশে ঘুরছেন। নিঃসন্তান মানুষ। রিটায়ার্ড লাইফটা কাটাচ্ছেন স্ত্রীর সঙ্গে । টুকটাক বাজার করেন সেটা দিয়ে চলে যায় উনাদের। আমাদের উপরের ফ্ল্যাটের মিজান চৌধুরীর খুনের ঘটনা সমাধান করার পর থেকে আমার আর মিলির সাথে এই দম্পত্বির সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ট। পিবিআই থেকে রিটায়ার্ড করা বয়স্ক এই লোকটার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা অস্বাভাবিক রকমের। মাঝে মাঝে মনে হয় নিশ্চয়ই উনি জাদু জানেন অথবা নিশ্চয়ই তাঁর থট রিডিং জানা আছে।
গুলজার আংকেল সুপার শপ থেকে এক কৌটা কফি নিলেন, আমার বাজার নেয়া ততক্ষণে শেষ। দুইজন একসঙ্গে কাউন্টারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি এই সময় একটা হৈ চৈ উঠল। তাকিয়ে দেখি সুপার শপে কোনায় একটা জটলা। সেখানে ড্রেস পরা কর্মীদের দেখা যাচ্ছে। কেউ একজন চিৎকার করে কেঁদে উঠল।
পড়ন্ত বিকেল। এই সময়ে সুপারশপে সাধারণত ভীড় কম থাকে। আজও লোকজন তেমন নেই। দুইএকজন যারা আছে তারা কিছুটা হতভম্ব হয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। আমি আর গুলজার আংকেল দ্রুত সুপার শপের কোণায় গেলাম। শপের এই দিকে একটা দরজা, দরজার ওই পাশে গুদামের মত। বড় একটা রুমে নানা জিনিসপত্র সাজানো। শপের ডিসপ্লেতে জিনিসপত্র ফুরিয়ে গেলে এখান থেকে নিয়ে আবার ডিসপ্লেতে রাখা হয়।
কয়েকজন ড্রেস পরা কর্মচারি, কর্মকর্তা দরজায় দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়ে ভিতরে দেখছিল। আমিও উঁকি দিলাম। ভিতরে একটা অল্প বয়সী ছেলে শুয়ে আছে তাকে ঘিরে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে বসা। মেয়েটা কাঁদছে। সবার গায়েই সুপার শপের ড্রেস।
কথাবার্তায় যা বুঝলাম ছেলেটা মারা গেছে। গুদামের ভিতর কিভাবে সে মারা গেল সেটা অবশ্য বোঝা যাচ্ছে না।
কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা হুলুস্থুল শুরু হলো।
সুপার শপের মেইন গেট আটকে দেয়া হল। আমি আর গুলজার আংকেলের মত আরোও গোটা দশেক কাস্টমার আটকা পড়ে গেল। পুলিশ আসছে, পুলিশ এলেই আমাদের সাথে কথা বলে দরজা খোলা হবে।
মিনিট বিশের মধ্যে পুলিশ এসে হাজির। ইতোমধ্যে কয়কজন ভদ্রলোক বিরক্ত হয়ে উঠেছেন। একজন মাঝ বয়সী ভদ্রমহিলা রেগে গিয়ে সুপার শপের লোকজনকে শাপ শাপান্ত করছিলেন। আমি এক কোণায় বসে গুলজার আংকেলকে দেখছি। উনি সুপার শপের ভিতরটা ঘুরে দেখছেন। কয়েকবার গুদাম ঘরটাতে গেলেন।
একবার এসে আমাকে নীচু গলায় বললেন, দম বন্ধ হয়ে মারা গেছে। সম্ভবত খুন। কেউ দম বন্ধ করে মেরেছে।
আমি কিছু বললাম না। গুলজার আংকেল যখন বলেছেন, দম বন্ধ করে খুন করা হয়েছে সেটা তাহলে তা-ই করেছে কেউ। উনার উপর কথা চলে না।
পুলিশ এসে গুলজার আংকেলকে দেখে চমকে গেল। মোহাম্মদপুর থানার ওসি রাকিব একসময় গুলজার আংকেলে সঙ্গে কাজ করেছে।
সে বলল, স্যার আপনি এখানে? বাজার করতে আসছিলেন?
হু রাকিব। এখানে একটা খুন হয়েছে দেখ। সম্ভবত খুনটা হয়েছে বেশীক্ষণ হয়নি। আমার বিশ্বাস খুনী এখানেই আছে। তুমি সব কিছু ঘুরে দেখ।
জ্বী স্যার দেখছি। কিন্তু আপনি দেখেছেন এরপর আর কি দেখব। তবুও স্যার আমি একটু দেখে আসি।
ওসি রাকিব চলে গেলেন।
কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে আমাদের সঙ্গে বসলেন।
স্যার একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখলাম, এদের সিসি ক্যামেরার রেকর্ডিং অফ করা ছিল। সিসি ক্যামেরা চলছে কিন্তু কোন রেকর্ডিং নেই। মনে হচ্ছে ইচ্ছা করে খুনী এই কাজ করেছে। সিসি ক্যামেরার দায়িত্বে যারা ছিল তারা মনে হচ্ছে এর সঙ্গে জড়ানো।
গুলজার আংকেল বললেন, সেটা না-ও হতে পারে। হয়ত তাঁর দায়িত্ব অবহেলায় কেউ এই কাজ করেছে। অথবা ভুল করে রেকর্ডিং অফ ছিল, যদিও এই সম্ভাবনা কম।
স্যার সবকটাকে এখানে ডেকে জেরা করি?
ডাকো।
দশজন ক্রেতাকে ইতোমধ্যে চলে যেতে দিয়েছে পুলিশ। তাদের নাম ঠিকানা লিখে রাখা হয়েছে, যদি কোন কাজে লাগে তবে ডাকা হবে।
সুপার শপে মোট কর্মকর্তা কর্মচারী এখানে বিশজন। সবাইকে এক এক করে ডাকা হলো।
কি করেন, কোথায় থাকেন, ফ্যামিলিতে কে কে আছে, নিজামের (মারা গেছে যে) সাথে কেমন সম্পর্ক ছিল, নিজামকে শেষ কখন দেখেছে ইত্যাদি সব কমন প্রশ্ন করল পুলিশ।
সেলসম্যান, গার্ড, ম্যানেজার, অন্য অফিশিয়ালদের প্রশ্ন করা হলো। চার কাউন্টারে ছয়জন ক্যাশিয়ার পালা করে ডিউটি দেয়। সবাই মেয়ে। তাদের কাছ থেকে তেমন কিছু উদ্ধার করা গেল না। তারা ভয়েই শেষ। যে মেয়েটা লাশ দেখে কাঁদছিল তার নাম রেহানা তার কান্না অন্যদের মধ্যেও ছড়িয়ে গেছে।
সবার জেরা শেষে পাঁচজনেকে আমার কাছে সন্দেহজনক লাগলো।
এর মধ্যে তিনজন খুন হওয়া নিজামের মতোই এই সুপার শপের সেলসম্যান ছিল। তাদের একজন রফিক মোটাসোটা। চোখের তাকানোই ভালো না। জেরার পুরাটা সময় ড্যাম কেয়ার ভাব নিয়ে থাকল। নিজের ঠিকানা দুইবার দুই রকম বলল, পরে পুলিশ তাঁর ভোটার আইডি বের করে সেটা মিলিয়ে দেখল। কথাবার্তায় ড্যাম কেয়ার ভাব , ভুল তথ্য দেয়ায় সবাই যখন বিরক্ত তখন হঠাৎ গুলজার আংকেল হঠাৎ বললেন,
তুমি মানুষের কাছ থেকে বোধহয় টাকা ধার নাও, আচ্ছা নিজামের কাছ থেকেও কি টাকা নিয়েছিলে? ফেরত দিচ্ছিলে না তাই না? কত?
এই কথা শক্তপক্ত রফিক চমকে গেল।
--ন না। কিভাবে?
গুলজার আংকেল হাসলেন, দেখো বহুদিন ধরে পুলিশে ছিলাম, তোমার অনেক খবরই এখন বলে দিতে পারি। ঠিক মতো সব খুলে বল।
ওসি রাকিব বললেন, কথা যদি আবার ভুল বল তাইলে সোজা থানায় নিয়ে ডলা দেব। নিজামের কাছ থেকে কত টাকা ধার নিয়েছিলি বল ব্যাটা। এইজন্য খুন করেছিস।
এইবার রফিক হাউমাউ করে উঠল।
--স্যার দশহাজার ধার নিছিলাম। এই মাসেই শোধ দিয়ে দিতাম। এইজন্য কেন নিজামকে মারব স্যার?
তাঁর কাছ থেকে আর তেমন কোন তথ্য পাওয়া গেল না।
সে সরে গেলে আমি এক ফাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, এই লোক টাকা ধার করে সেটা কিভাবে বুঝলেন গুলজার আংকেল?
আংকেল হাসলেন, ওর মোবাইলটা টেবিলের উপর সাইলেন্ট করে রাখা ছিল। সেখানে এই পনের মিনিটে দুইটা ম্যসেজ এসেছে, দুইটাই টাকা ফেরত চেয়ে। টাকা ধার করা মানুষগুলো সাধারণত আশেপাশের সবার কাছে অবলীলায় টাকা ধার করে এবং সহজে ফেরত দেয় না, এইটা খুবই কমন একটা সাইকোলজি ওদের। সেই জন্যই ঢিল মারলাম একটা। লেগে গেছে।
আমার সন্দেহ করা বাকি দুই সেলসম্যানের কথাবার্তায় মনে হল তারা নিজামের খুব ঘনিষ্ঠ ছিল। কিন্তু তারা বলছে তারা আজ নিজামকে ওই রুমে ঢুকতে দেখেনি।
সেলসম্যানদের বাইরে অন্য যে দুইজনকে আমার সন্দেহ হয়েছিল তাদের একজন এখানকার ম্যানেজার। মোটাসোটা এই ভদ্রলোক কেমন উদ্বিগ্ন হয়ে আছেন। তাঁর ভাব ভঙ্গীতে একটা অতিরিক্ত টেনশন। কেমন চোর চোর ভাব। একটু পর পর রুমালে ঘাম মুছছেন। আমার কাছে সন্দেহজনক মনে হল। সবচেয়ে বড় কথা সিসি ক্যামেরার ভার তার উপর। সিসি ক্যামেরায় যে রেকর্ডিং অফ করা সেটা তার জানার কথা, যদি সে ইচ্ছে করেই সেটা অফ না করে।
আমার সন্দেহের শেষজন এখানে মাছ আর মাংস কাটার কাজ করে। লোকটাকে আমার সন্দেহ হলো কারন লোকটা কানে না শোনার ভাণ করছে বলে মনে হল আমার। কয়েকবার প্রশ্ন করলে একবার জবাব দেয়। তাকিয়ে থাকে, মনে হল ব্যাটা ইচ্ছে করেই এমন করছে। নিশ্চয়ই ব্যাটার একটা ঝামেলা আছে।
আমার দৃষ্টিতে এই পাঁচজনের একজনই খুন করেছে। যদিও বোঝা যাচ্ছে না পরিষ্কার তবু পুলিশ যদি একটু ডলার ভয় দেখায় তাহলে নিশ্চয়ই এদের একজন খুনের কথা স্বীকার করবে। আমি ইন্সপেক্টর রাকিবের দিকে তাকালাম। তাকে বেশ বিভ্রান্ত মনে হল।
তিনি গুলজার আংকেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, স্যার আমি কিছু ধরতে পারলাম না পরিষ্কার করে, আপনি কি কিছু বুঝতে পেরেছেন?
গুলজার আংকেল চিন্তিত ভঙ্গীতে বললেন, হু তবে পরিষ্কার হয় নি এখনও। দাঁড়াও পুরা ব্যপারটা আমরা অন্যভাবে বিশ্লেষণ করি। ওদের জেরা করে কি জানতে পেরেছি দেখ,
১. নিজামকে কেউ ওই গুদাম ঘরে ঢুকতে দেখেনি। অন্তত কেউ স্বীকার করে নি।
২. দুপুর ২ টা থেকে সি সি ক্যামেরা বন্ধ। যদি এটা প্ল্যানড হয় তাহলে বুঝতে হবে এই ক্যামেরা বন্ধের কিছু পরেই এই ঘটনা ঘটেছে। এখন বিশ্লেষণ কর, ম্যানেজার যদি এই প্ল্যানে জড়ানো থাকত তাহলে সে সি সি ক্যামেরা সকাল থেকেই বন্ধ করতে পারত অথবা অন্য কোন টেকনিক্যাল ফল্ট দেখিয়ে সে মেকানিক ডেকে নিজের দোষ ঢাকার চেস্টা করত, খুন করার কিছু আগে রেকর্ডিং বন্ধ করে সন্দেহের মধ্যে সে পড়তে চাইত না। খুনী অন্য লোক বলেই খুনের অল্প কিছু আগে সুযোগ মত ক্যামেরার রেকর্ডিং অফ করেছে কারণ খুনী যদি সকালে ক্যামারের রেকর্ডিং অফ করত তাহলে খুব ভালো সুযোগ ছিল এরমধ্যে ম্যানেজারের চোখে পড়ত আর সে রেকর্ডিং অন করে দিত। অর্থাৎ দুইটা থেকে লাশ পাওয়া গেছে চারটা পর্যন্ত যে কোন সময় খুনটা হয়েছে।
৩. যা বোঝা যাচ্ছে, মুখের উপর কিছু চেপে ধরে দম বন্ধ করে মারা হয়েছে নিজামকে। সে লম্বায় প্রায় পাঁচ ফুট আট। তাকে কোন আঘাত করে ফেলে দিয়ে তারপর তার উপর চেপে বসে তাকে মারা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। সেটা করতে হলে নিজাম থেকে শক্তিশালী লোক লাগবে। এই রকম শক্তিশালী লোক কয়জন আছে এখানে লক্ষ্য কর। ছয়জন। ম্যানেজার, মাছ মাংস কাটে যে লোকটা সিরাজ, সেলসম্যান রফিক, রতন আর দুই গার্ড মোর্শেদ, সুজন।
৪. ম্যানেজার হওয়ার সম্ভাবনা কম, আগেই বলেছি কারণ। দুই গার্ড দরজার কাছ থেকে ভিতরে গিয়ে খুণ করে আবার দ্রুত গার্ড দিতে চলে আসবে সেটাও অস্বাভাবিক। তাহলে রতন, রফিক আর সিরাজের মধ্যে একজনের সম্ভাবনা খুব বেশী। তুমি তিনজনকে আবার ডাক কথা বলি।
লোকগুলোকে ডাকা হলো। এই ফাঁকে আমি নীচু গলায় গুলজার আংকেলকে বললাম, আংকেল একজন কেন দুইজন বা তার বেশী লোকও এই খুনের সাথে জড়ান থাকতে পারে না?
গুলজার আংকেল আমার দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে গেলেন। মনে হল আমার কথাটা চিন্তা করে দেখছেন উনি। ভুরু কুঁচকে কিছু ভাবছেন এখন।
প্রথমে আসল সিরাজ, সে এখানে মাছ মাংস কাটার কাজ করে। দশাসই চেহারা। সে ঢুকতেই ওসি সাহেব বলল, বস সিরাজ। তুমি না শোনার ভাণ করছ কিন্তু আমরা এদিকে খুনীকে ধরার কাছাকাছি পৌঁছে গেছি।
সিরাজ এইবার কেঁপে উঠল।
ওসি সাহেব বললেন, সিরাজ তোমার হাতের এক নখে ব্যান্ডেজ কেন?
সে ভয়ে ভয়ে বলল, স্যার আজ দুপুরে মাংস কাটতে গিয়ে থেঁতলে গেছে।
দেখো আমাদের সাথে চালাকি করো না, আজ দুপুরেই তোমার হাত থেঁতলে গেল নাকি নিজামের সাথে ধ্বস্তাধ্বস্তিতে থেঁতলে গেছে। তুমিই তো নিজামকে মারছ তাই না? টাকা পেতে না অন্য কারণ আছে?
সে হাউমাউ করে উঠল, না স্যার। আমি খুন করিনি।
গুলজার আংকেল হঠাৎ ঝুকে বললেন, সিরাজ, রেহানা নামের ক্যাশিয়ার মেয়েটার সাথে তোমার কি সম্পর্ক?
সিরাজ ভয়ানক চমকে গেল। তারপর ইতস্তত করে বলল, স্যার সে আমার মেয়ে।
এবার আমরা চমকালাম।
ওসি সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, মেয়ে? সুপার শপের লোকজন জানে?
না স্যার। বলিনি কাউরে। আমার মেয়ে মাস্টার্স পাশ করছে, বড় চাকরি করবে, আমি সামান্য মানুষ , কসাইয়ের কাজ করি । তাছাড়া এইখানে লোকজন হাসাহাসি করবে তাই আমরা কাউকে বলি নাই। কিন্তু স্যার আপনি কিভাবে বুঝলেন?
গুলজার আংকেল হাসলেন, অবজার্ভেশন। মেয়েটা যখন কাঁদছিল ভীড়ের মধ্যে তুমি তার পাশে দাঁড়িয়েছিলে। একবার তার মাথায় হাতও দিয়েছ। অবশ্য খুব অল্প সময়ের জন্য, সেটাই আমার চোখে পড়ে গেছে। এখন পুরা ঘটনা খুলে বল। কি হয়েছে আজ? তোমার মুখ থেকেই শুনতে চাই।
সিরাজ চোখ মুছল। স্যার আমিই খুন করছি নিজামরে। সে জাইনা গেছিল যে রেহানা আমার মেয়ে, টিটকেরি দিত নানা সময়ে, আমার সহ্য হয় নাই। আইজকা সে যখন মাল আনতে গুদামে ঢুকছে তখন আমি পিছ থেকে যেয়ে বাড়ি দিয়ে ফালাই দিছি তারপর তার দিয়ে নাক মুখ চাইপা ধরছি। খেল খতম।
ওসি সাহেব বললেন, তোমার মেয়ের সাথে কি নিজামের কোন সম্পর্ক ছিল?
সিরাজ কিছুক্ষণ কাঁদল তারপর বলল, না স্যার।
কিন্তু আমরা বুঝে গেলাম উত্তরটা আসলে ভিন্ন।
সিরাজ গ্রেফতার হয়ে গেল। আমি আর গুলজার আংকেল বাসায় চলে এলাম। গুলজার আংকেল সারা রাস্তা গম্ভীর হয়ে রইলেন। ভাবলাম এই পুরা ঘটনা তার মনের উপর চাপ ফেলেছে। অস্বাভাবিক কি, আমার নিজেরই অদ্ভুত অনুভুতি হচ্ছে। এক বাবা তার মেয়ের জন্য খুন করে ফেলেছে। আইনের চোখে নিশ্চয়ই সে দোষী কিন্তু সমাজের চোখে সে আসলে কতটুকু দোষী?
সন্ধ্যার দিকে আমি আর গুলজার আংকেল ছাদে বসে ছিলাম। গুলজার আংকেল হঠাৎ বললেন, কেসটা এতটা সরল ভাবে শেষ হলো মেহেদী মনে হচ্ছে কিছু না কিছু এড়িয়ে গেছি আমরা।
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, কি এড়িয়ে গেলাম। লোকটা খুনের কথা স্বীকার করেছে, ক্রিস্টাল ক্লিয়ার কেস।
হু। কিন্তু তার খুনের বর্ননার সাথে কিছু জিনিস মেলে না। নিজামের লাশের মুখে আটা লেগে ছিল লক্ষ্য করেছ?
দেখেছি, সম্ভবত আটার বস্তার উপর মুখ থুবড়ে পড়েছিল।
গুলজার একবার ‘হু’ বলে চুপ করে গেলেন। বুঝলাম কোন কিছু ভাবাচ্ছে তাকে।
পরদিন সকালে গুলজার আংকেল ফোন দিয়ে বললেন, মেহেদী রাকিব ফোন করেছিল, রেহানা নামক মেয়েটা মারা গেছে কাল রাতে গাড়ি এক্সিডেন্ট করে। আমার মনে হচ্ছে কেসটা অত সহজ না, সম্ভবত সিরাজ খুনী না। আমি থানায় যাচ্ছি তুমি যাবে?
সংগ্রহ ঃ বইপোকা গ্রুপ ।