একটি ফুলের আশায়(ইমোশনাল গল্প)

কল্পকথার-রাজ্য
0

 



 একটি ফুলের আশায়

আমার স্বামী আমাকে বহুদিন বলেছিল তাকে ডিভোর্স দিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করে নতুন করে ঘর বাঁধার জন্য। আর আমার স্বামী আমাকে এতটাই ভালোবাসে যে কখনো তাকে ছেড়ে যাবার কথা চিন্তাও করতে পারি না। নিজের বাবা মায়ের মতো যদিও কেউই অাদর করে না, তবুও আমার শ্বশুর শাশুড়ি আমাকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসে। 

লোকমুখে শুনতাম বউ শাশুড়ির না-কি যুদ্ধ হয়। অথচ আমার শাশুড়ি আমাকে নিজের মেয়ের মতো করে, ভালোবাসা দিয়ে অাগলে রেখেছে। তেমন শ্বশুর শাশুড়ির ভালোবাসা রেখে আমি কোথায় যাব? 

আমি এই পরিবারের বড়ো বউ। আমার দুটি দেবর পরে বিয়ে করেছে। দেবর দু'জন আমাকে যথেষ্ট সম্মান করে। দেবরের বউ দু'জনও বড়ো বোনের মতো ভালোবাসে। ওদের এত ভালোবাসা রেখে আমি কোথায় যাব? একটি সন্তান-ই কি সব? না-কি সবকিছুর মূলে রয়েছে সবার ভালোবাসা?


আট দশটা মেয়ের মতো আমিও চোখে জল নিয়ে লাল বেনারশি পরে, অজানা এক ভয় নিয়ে এই বাড়িতে বউ হয়ে এসেছিলাম। 

পারিবারিক মতামতের উপর ভিত্তি করে বিয়ে হওয়াতে আমার স্বামীকেও আমি ভালো করে চিনতাম না। 

অথচ তার মায়ার বাঁধনে সে কতটা অাপন করে জড়িয়েছে আমাকে। তাকে ছাড়া অন্য কিছু কল্পনাই করতে পারি না। 

কখনো কারো প্রেমে পড়িনি। খুব ইচ্ছে ছিল বিয়ের পর স্বামীকে ভালোবাসব। আমার অাশা অার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। মজার বিষয় হলো,  বিয়ের রাতে আমার স্বামী অামাকে প্রেম নিবেদন করেছে। 

খুব একটা গুছিয়ে নয়, তবুও কথাগুলো ভালো লেগেছিল। 

"সোমা, আজ নতুন জীবনের শুরুতে কথাগুলো কীভাবে নিবে জানি না। তবুও আমাকে কথাগুলো বলতেই হবে। আমি লাট সাহেবের ছেলে নই, মোটামোটি বেতনে চাকরী করি। আমি হয়তো তোমাকে দামী দামী সোনা গয়না প্রতিমাসে দিতে পারব না। বা বড়ো বড়ো স্বপ্ন পূরণ করতে পারব না। তবে আমার মনে জমিয়ে রাখা ভালোবাসা দিতে পারব। সারাজীবন বুকে অাগলে রেখে ভালোবাসতে পারব। তুমি কি আমাকে ভালোবাসবে? আমি একটিবার তোমার প্রেমে পড়তে চাই।" 

কী দিব উত্তর আমি? আমার স্বামীর কথায় অামি তার প্রেমে পড়ে গেছি। শুধু ছোটো করে একটি কথা বলেছিলাম, "আমি আপনাকেই চাই, আপনার ভালোবাসা চাই।"

প্রথমবার কথা বলেছিলাম তো, তাই অাপনি করে বলেছিলাম। পরদিন থেকেই তুমি করে বলতে হয়েছে। 


এর পর থেকে যে আমি তার প্রেমে পড়েছি, আজও পর্যন্ত সে আমাকে কোনো প্রকার কষ্ট দেয়নি। কষ্ট তো দিয়েছে আমার ভাগ্য। যদিও বহু ডাক্তার দেখানোর পরও অামাদের দৈহিক সম্পর্ক এক প্রকার হতো না বললেই চলে। কিন্তু আমার স্বামীর অফুরন্ত ভালোবাসা ছিল। শেষে উন্নত ডাক্তার দেখানোর জন্য আমার স্বামীকে ইন্ডিয়াতে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখান থেকেও একই রিপোর্ট অাসল। আমার স্বামীর বাবা হওয়ার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে। 

ইন্ডিয়া থেকে এসে সেদিন আমার স্বামী আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কেঁদেছে। যদিও এই প্রথম তার কান্না আমি দেখতে পেয়েছি। কেঁদে কেঁদে বলছিল, 

"জানো সোমা? আমি কোনোদিন বাবা হতে পারব না। আমার না-কি সে ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে। তুমি যে বলেছিলে তোমাকে পরীর মতো একটা ফুটফুটে বাবু এনে দিতে,আমি কখনো তোমার পরীর মতো বাবু এনে দিতে পারব না। আমি অনেক অসহায়। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও সোমা। তুমি আমাকে ডিভোর্স দিয়ে চলে যাও। অন্য কাউকে বিয়ে করে সুখী হও। অন্য কেউ অবশ্যই তোমাকে পরীর মতো বাবু এনে দিতে পারবে। "

সেদিন আমার স্বামীর সাথে আমিও কান্না করেছি। বলেছি, "তোমাকে ছেড়ে গিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করে সুখী হতে পারব না, তোমার এখানেই আমি সুখ খুঁজে নেব।"

দ্বিতীয়বার আমার স্বামী কেঁদেছিল আমার পাগলামি দেখে। এলাকার মেলা থেকে আমি বড়ো একটি পুতুল কিনেছিলাম। আমার স্বামী অফিস থেকে ফিরে দেখে আমি পুতুলকে ঘুম পাড়াচ্ছি। "কাঁদে না সোনা আমার, ক্ষিধে পেয়েছে? এই নে,  খেয়ে লক্ষ্মী মেয়ের মতো ঘুমিয়ে পড়।" আমার স্বামী সেদিও বলেছিল, "তুমি অন্য কাউকে বিয়ে করে সুখী হও।"

আমি যথাসম্ভব নিজেকে হাসি খুশি রাখি। যাতে কেউ বুঝতে না পারে অামি কষ্টে আছি। এমনিতেই বাড়ির সবাই জানে যে, বাকি জীবন আমাকে সন্তানহীন থাকতে হবে।  একটাই তো কষ্ট, বিয়ের পর মা না হতে পারার যন্ত্রনা কতটুকু তা কেবল তারাই বলতে পারবে যাদের কোনো সন্তান নেই। আমিও কাঁদি, তবে অন্ধকারে নিঃশব্দে।


মেজো দেবরের বউ গর্ভবতী। সে আমাকে বুবু বলে ডাকে। তার কোনো বোন নেই তাই তার বোনের জায়গাটা আমার জন্য রেখেছে। সে দুয়েকদিন ধরে আমার সামনে অাসে না, লুকিয়ে থাকে। তার ধারনা তার সন্তান হবার খবর শুনে আমি খুশি না হয়ে কষ্ট পেয়েছি। আমি কষ্ট পাব কেন? শুধু দীর্ঘশ্বাস নিয়েছিলাম। 

আমি ডেকে এনেছি তাকে। 

এই শেফালী, একটু শুনে যাও তো। 

বুবু বলে কাছে এসে মাথা নিচু করে অাছে। আমি বললাম, "কী রে, এত বড়ো একটা খুশির সংবাদ।  তোমার বুবুর মিষ্টি কই?"

প্লেটে করে দুইটা মিষ্টি নিয়ে এলো। হঠাৎ দেখি শেফালী কান্না করছে। 

-এই, শেফালী তুমি কাঁদছ কেন? 

মুহূর্তে চোখ মুছে অনর্গল কথা বলছে। "জানো বুবু, আমি প্রতিদিন অাল্লাহর কাছে দোয়া করি আমার যেন দুইটা সন্তান হয়। আমি তোমাকে আমার একটি সন্তান দিয়ে দেব। আমার স্বামীকেও বলে রেখেছি।" 

আর রাখতে পারিনি চোখের পানি। শেফালীকে জড়িয়ে ধরেছি অনেক্ষণ কেঁদেছিলাম সেদিন। 


আল্লাহ এক সাগর সমান দয়া,মায়া নিজের কাছে রেখেছেন,আর এক ফোটা পানি পরিমান দয়া মায়া   সারা দুনিয়ার মানুষকে দিয়েছেন। তাহলে অাল্লাহ কত দয়ালু! 

আমার মেজো দেবরের বউ অর্থ্যাৎ শেফালীর জমজ মেয়ে হয়েছে। যেদিন হয়েছে সেদিনই আমাকে তার এক মেয়েকে দিয়ে দিয়েছে। আমার দেবর, শ্বশুর শাশুড়ি কেউ আপত্তি করেনি। বলেছে বুকের দুধ খাওয়ার বয়স পার হলেই নিয়ে যেতে। 

অামার সারাজীবনের সুখ একত্র করলেও সেদিনের সুখের মূহূর্তটার সমান হবে না। শেফালীর এই অাত্মত্যাগ আর ভালোবাসার মূল্য আমি কোনোদিন দিতে পারব না। 


স্বামী যেখানে চাকরী করে আমরা যেখানে বাসা নিয়েছি। আমার মেয়ে এবার ক্লাস ওয়ানে পড়ে।  তার নাম রেখেছি তানিশা। 

আজ আমার মেয়ে বলছে, "মা তুমি একটু শুয়ে পড়ো তো?"

 আমি প্রশ্ন করলাম, কেন?

বলল, "তোমার পেটের উপর মাথা রেখে শুইব।"

একটু পরেই আমার পেটের উপর মাথা রেখে তানিশা ঘুমিয়ে পড়েছে। 

জমজ সন্তান না-কি দেখতে একই রকম হয়। তবে তানিশার চেহারার সাথে শেফালীর মেয়ের চেহারা আর দৈহিক গঠন অালাদা। অাল্লাহ তানিশাকে আমার জন্যই পাঠিয়েছে। 

আল-হামদুলিল্লাহ।


সত্য ঘটনা অবলম্বনে

ঘটনা: সুমি আক্তার, ফরিদপুর।

লেখা: ১২ই নভেম্বর, ২০১৭ইং


লেখনীর শেষ প্রান্তে,,,,,,,,,,

,,,,,,,,ওমর ফারুক শ্রাবণ


সংগ্রহ ঃ বইপোকা গ্রুপ । 

Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)